বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে বড় পরিবর্তন নিয়ে আসার মতো সিনেমা আমাদের দরকার নেই। তার থেকে বেশি দরকার সেই পরিবর্তনের ছোট ছোট পদক্ষেপগুলো। পুরনো ধ্যানধারণা থেকে বের হতে হবে। ইন্ডাস্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি করে বুক ফাটিয়ে চিল্লালেই হবে না, আগে ইন্ডাস্ট্রিকে ইন্ডাস্ট্রি বলার মতো জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। এরকম ছোট পদক্ষেপের মধ্যে একটি এই সিনেমাটি। "Halt" সিনেমাটি ছোট ছোট তিনটি গল্প দিয়ে সাজানো। তিনটি ছোটগল্পের নাম যথাক্রমে "কলসের ব্যাঙ", "ছেঁড়া জুতার গল্প" ও "Halt"। Gaushey Alexander পরিচালিত এই সিনেমাটি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে যে কিছু দিতে পারবে তা বলছি না তবে বাংলাদেশের সিনেমাকে কিছুটা হলেও আশা দিতে পারবে। ইনডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকার বাংলাদেশে খুব একটা নেই। সেই জায়গায় যারা আছেন, তারা থেকেও নেই বা আছেন আর কি। কেননা ব্যবসাটা তো বড় একটা ফ্যাক্টর। আবার ইনডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকার না হলে পরিচালকরা নিজের গল্প বলতে চান না, মানুষ যে গল্প শুনতে চায়, সে গল্প বলার জন্য উঠে পরে লেগে যান। আবার এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে ইন্ডি ফিল্ম গুলো বেশির ভাগ সময়ই সিনেমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণেই হয়ে থাকে। তবে "Halt" সিনেমাটিকে নিঃসন্দেহে একটা পূর্ণাঙ্গ ফিচার ফিল্ম হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। এখানে তিনটি গল্পেরই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সিনেমাটোগ্রাফি বেশ চমৎকার, বিশেষ করে প্রথম গল্পে সুমন সরকার এর কাজ খুবই অসাধারণ ছিল। গল্প বলার ধরন বেশ মজার ছিল, সুন্দর পরিপাটি সাজানো গোছানো বলা যায়, তবে একটা বিষয় হচ্ছে গল্প ন্যারেশন পেস বা স্পিড যেটা আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে মনে হচ্ছিলো আরেকটু ফাস্ট হতে পারতো, সেক্ষেত্রে সাবকন্টেক্সট এর খেলাটা হইতো একটু শক্ত করে খেলতে হতো, তবে অনেকেই ব্যাপারটায় দ্বিমত পোষণ করতে পারে। আরেকটি বিষয় এই সিনেমায় লক্ষণীয় সেটা হচ্ছে, প্রথম গল্পটা তৈরিতে পরিচালক যতটা যত্নশীল ছিলেন, তা শেষ গল্পে হ্রাস পেয়েছে বা ততটা যত্নশীল তিনি ছিলেন না (ব্যক্তিগত মতামত)। তবে প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে আসলেই অসাধারণ। আমার শুধু একটাই আশা, এই পরিচালক অন্তত হলেও তাঁর ক্যারিয়ারে ৫০টার মতো চলচ্চিত্র তৈরি করুক, হারিয়ে না যাক, উনার অনেক কিছু দেওয়ার আছে, আমাদেরও অনেক কিছু উনার কাছ থেকে পাওয়ার আছে।
"কলসের ব্যাঙ"
ইলুউশন বা মালটি-ইলুউশন, অন্য লেভেলের জিনিষ বাবা। এই পর্যায়ে নিয়ে খেলতেও না অনেক সাধনার প্রয়োজন হয়ে থাকে। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। মানুষ বিশ্বাস করার জন্যই বসে থাকে, বিশ্বাস করুন। ছোটবেলায় এরকম উদাহরণ আমরা সকলেই মোটামোটি দেখেছি। নিজের চোখে দেখলেই বুঝা যায় তা কতটা ভয়ংকর। মানুষ এর বিশ্বাস অর্জন করতে পারলে সেই অন্ধবিশ্বাস রক্ষার্থে সে কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে তা অবিশ্বাস্য। ডাক্তার যেখানে ব্যর্থ বাবার সেখানেই আবির্ভাব। সুশিক্ষা যেখানে প্রবেশ করেনি, কুসংস্কার সেখানেই থাবা দিয়েছে। শিক্ষার হার যে পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে পরিমাণে কুসংস্কার কমছে না, কেননা শিক্ষা আর স্বশিক্ষার মাঝে আমরা এখনো আটকে রয়েছি। আমি এক পীরের মজলিসে গিয়েছিলাম, এক গ্রামের খোলা মাঠে যার আসর বসেছিলো, অবাক তখন হলাম যখন দেখলাম এক কোটিপতি তার কাছে উনার মেয়েকে নিয়ে আসলেন, উনার মেয়ে সুস্থ হলেন কিনা জানি না, আমার মন অসুস্থ হয়ে গেলো। ওই কোটিপতিকে খুবই অসহায় দেখাচ্ছিলো, আমাদের সমাজের মতোই।
এই গল্পের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশটি ছিলো পীরের মুরিদের পাঠটি এবং যেভাবে এই সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছিলো সেগুলোর চিত্রায়ন। সিনেমাটোগ্রাফি দুর্দান্ত, সংগীত আয়োজন একের হয়েছে।
"ছেঁড়া জুতার গল্প"
এক বনিকের গল্প হিসেবেও ব্যপারটাকে ধরে নেওয়া যায়। ঘোঁটে থাকলে বুদ্ধি পদ্মফুলের চাষ গোবরেও করা সম্ভব। এই গল্পের সবচেয়ে বড় মাইনাস পয়েন্ট যেটা ছিলো তা হলো শেষে কি ঘটবে তা আগে থেকেই বুঝা যাচ্ছিলো, বিশেষ করে যখন গ্রামের লোকজন অনেক ছেঁড়া জুতোর সন্ধানে বের হলো, কাহিনী সেখানেই সমাপ্ত হলো। আশা করেছিলাম সাসপেন্সটা অনেকক্ষণ ধরে রেখে উন্মোচন করা হবে, তা সেই সুযোগ পায় নি। তবে পরিবেশনটা বেশ ইউনিক ছিলো, এরকম ঘটনা ঘটছে ব্যাপারাটা ভাবতেই মজা লাগছিলো। ঘোড়ায় চড়ে বনিক আমাদের দেশে/গ্রামে আসে না, কিন্তু এখানে এসেছে, এটা মজা লেগেছে। ভাষার ব্যবহার খুবই সুন্দর ছিলো। পরিচ্ছন্ন কাজ বলা যেতে পারে।
"Halt"
এই সিনেমার শেষের পরিবেশনটি ছিলো "Halt"। এই গল্পের সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট ছিলো আসল রহস্য শেষ অবধি ধরা সম্ভব ছিলো না। তবে বিষয়টি আরও ডিটেইলসে দেখাতে পারলে বেশ জমে যেতো। A cat and mouse story এর মতো তা সম্পূর্ণরূপে গড়ে উঠতে পারে নি, অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে। মনে হচ্ছিলো পরিচালক যেন গল্পটাকে সহজ করে দেখিয়েছেন, পেঁচিয়ে ভুল না করার জন্য। এটা অবশ্যই উত্তম সিদ্ধান্ত তবে তা উচ্চাভিলাষী নয় (ব্যক্তিগত মতামত)।
পুরো সিনেমায় অভিনয় শিল্পিদের প্রত্যেকের কাজ খুবই ভালো ছিলো। সাধারণ সুন্দর অভিনয়। যা গল্পগুলোকে ফুটিয়ে তুলেছে আরও সুন্দর করে।
পরিচালক Gaushey Alexander কে অনেক অনেক ধন্যবাদ এরকম উদ্যোগ নেওয়ার জন্যে। আমাদের দর্শকদেরও উচিৎ এই পরিচালকের সাথে থেকে বাংলা সিনেমাকে তুলে ধরতে সাহায্য করা। সিনেমাটি দর্শক কোনও টাকা খরচ না করেই দেখতে পাবেন। সিনেমাটির লিঙ্কঃ https://youtu.be/L-9fuZaQ0eE । সকলকে সিনেমাটি দেখার আমন্ত্রণ রইলো।
Comments