"জোজো র্যাবিট" ওয়ার/কমেডি ঘোরানার মুভি। এই মুভিটি দেখে আমি অনেকদিন পর সিনেমা সম্পর্কে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছি। অনেক সুন্দর করে সাজানো গোছানো একটি সিনেমা। সিনেমাটির কাহিনী এবং চিত্রনাট্য এমন করে সাজানো যার পরতে পরতে কিছু না কিছু লুকিয়ে থাকা অর্থপূর্ণ গল্প রয়েছে। যা দেখে আমরা খুবই স্বাভাবিকভাবে হাঁসতে বাধ্য কিন্তু তারই গভীরতা ভাবলে নিছক কমেডি থেকে আরও বড় কিছু বের হবে।
সিনেমা বিষয়টা আসলে বই পড়ার মতো। বই পড়ে আমরা যে আনন্দ পাই এবং যেভাবে তাঁর দাঁড়া প্রভাবিত হই, সিনেমা দেখে সেভাবেই আমাদের অনুভূতিগুলো কাজ করবে বা করা উচিৎ। কিন্তু এখনকার সময়কার সিনেমাগুলোতে তা নেই, নিছক বিনোদন দেওয়াই এখন মুখ্য বিষয়। আমার কাছে মনে হয়েছে জোজো র্যাবিট সিনেমাটি একটা বই ছাড়া কিছুই নয়। বইটাই এতো মজার যে তা দেখেই মজা লাগছে। বিনোদন এর অংশটুকু এখানেই মনভরে পূরণ হচ্ছে। বাকি রইলো পুরা সিনেমাটি, এটা শুধুই পড়ার বাকি।
আমি প্রথমত মুভিটি দেখতে চাইনি। কেন জানি, জানি না, আমি হিটলার এর বিশাল বড় ফ্যান। আমি জানি উনি মোটেও ভালো কেউ ছিলেন না, কিন্তু আমি তাঁর ভক্ত। তো মোটামোটি প্রত্যেকটি মুভিতেই তাকে নিচু করে দেখানো হয়, যা আমার মোটেই পছন্দ না। এই মুভিটিও তাঁর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এইখানে হাস্যরস এর মধ্যেই হিটলার প্রিয়তার বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এবং কেনো সে প্রিয় হওয়া উচিৎ নয় তাও এখানে স্পষ্ট। তবে একটা কথা বলে রাখি পুরা সিনেমাটি আমাকে প্রভাবিত করলেও, আমি এখনো হিটলারের ফ্যান। এইটা সহজে যাবে না বস।
মুভিটির শুরুতেই জোজো সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। তার বয়স ১০। পুরো জগতটি তার কাছে এখনো অপরিচিত। এই বয়সটিতে আমরা যে শিক্ষা পেয়ে থাকি আমাদের পরিবেশ বা সমাজ থেকে তা কিন্তু আমাদের জন্য অনেকটা ইউনিভারসেল ট্রুথ বলে গণ্য হয়, সারাজীবন যা আমাদের বয়ে বেড়াতে হয়। সেই ধ্যান ধারণা থেকে খুব কম মানুষই পারে বের হয়ে আসতে। পারলেও তাতে অনেকটা সময় বেশি লেগে যায়। জোজো ঠিক সেই প্যাঁচে পরে যাওয়া এক তরুণ। তার আদর্শ গড়ে উঠতে থাকে হিটলার কে কেন্দ্র করে। যেখানে শুধু ভুল আর মিথ্যের ছড়াছড়ি। কিন্তু জোজো মনে মনে হয়তো সেই আদর্শটাকে শক্ত করে ধরতে পারেনি, সে বার বারই নিজের সাথে যুদ্ধ করে গেছে, তার আদর্শের বিরুদ্ধে। এখানেই সিনেমাটির কাহিনী গড়ে উঠে।
সিনেমাটির প্রেক্ষাপট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জার্মান সমাজে এই যুদ্ধের গুরুত্ব এই সিনেমায় স্পষ্ট। কিন্তু সিনেমাটিতে কোনও গম্ভীর মুহূর্ত নেই। সাজানো গোছানো এই সিনেমার আকর্ষণীয় দিকটি হলো এর কালার প্যালেট। রঙ নিয়ে মারাত্মকভাবে খেলেছেন এই সিনেমার ডিরেক্টর। এই রঙ এর কম্বিনেশনের কারণে সিনেমাটিকে মনে হয়েছে সাজানো গোছানো টকটকে লাল ফুলের মতো যাতে রক্তের গল্প বলা হচ্ছে।
ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের কথা বললে প্রথমেই আসে বিটলস এর গান "I wanna hold your hand" । এই ট্র্যাকটি আমার অন্যতম পছন্দের। আর পুরো সিনেমাটির অনুভূতিগুলোকে ফুটিয়ে তুলতে যেসব আবহসঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো এক কথায় অসাধারণ।
এই দুইটি সিন এই সিনেমায় আমাকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। কি করে মুহূর্তের মধ্যেই একটি ফুটন্ত লাল ফুল নিরাসক্ত লাল রক্তে পরিণত হয়। কিভাবে মুহূর্তে সকল আদর্শ ধ্বংস হয়ে যায়। বয়সটি তার মাত্র ১০। সে কি তা বুঝবে? সে কি বুঝবে যে তার এখান থেকে পালানোরও জায়গা নেই। সিনেমাটিতে মা ছেলের যে সম্পর্ক এখানে স্থাপন করা হয়েছে তা হয়তো খুব কম মুভিতেই এতো সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
পুরো বইটিকে আমরা হইতো এই সিন এর দাঁড়া বিশেষায়িত করতে পারি। যুদ্ধ হচ্ছে, আমরা শূন্য হচ্ছি। যুদ্ধ হচ্ছে, আমাদের কি লাভ হচ্ছে?
আমার অনেক কথাই থেকে যায় বলার জন্য কিন্তু বুঝে উঠতে পারি না, তা প্রকাশে কোন ভাষার প্রয়োগ করতে হবে। সেই ভাষা তখন হয়তো সিনেমায় রূপ নিতে পারে। এই সিনেমায় সেই ভাষার প্রয়োগ দুর্দান্ত। আমি নিজে দেখে খুব এঞ্জয় করেছি, আবার আমাকে ভাবার জায়গাটুকুও দিয়েছে সিনেমাটি। আমি প্রত্যেককেই এই মুভিটি অন্তত একবার দেখার অনুরোধ জানাবো।
Commentaires