"শুনতে কি পাও" নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। প্রথম কাজেই যেনো একদম বাজিমাত ব্যপার। প্রত্যেকটা বাঙ্গালীকে এই সিনেমা টিভিতে চালিয়ে দেখানো উচিৎ। এই সিনেমার সবচেয়ে বড় ভালো লাগার বিষয় হচ্ছে এখানে গরিবি হাল দেখানোর জন্য আপনাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে না। ব্যপারটা অনেকটা যা ঘটছে তাই দেখানো হচ্ছে এরকম।
সিনেমার পটভূমি আইলা দূর্গত এলাকার একটি পরিবারকে নিয়ে গড়ে উঠেছে। আমার কাছে মনে হয়েছে খুব বেশি দরকার না হলে কোনো বাড়তি সিন এইখানে ব্যবহৃত হয়নি। স্টোরি টেলিং এক কথায় দুর্দান্ত। এই চলচ্চিত্র নিয়ে যে ফিকশন, নন-ফিকশন এর সমালোচনা শুনেছি তা মনে হয়েছে যুক্তিহীন। ফিকশন কে নন-ফিকশন স্টাইলে উপস্থাপন করলেই তা নন-ফিকশন বা ডকুমেন্টারি হয়ে যায় না। তবে কিছু কিছু জায়গায় যখন পিচ্চিটি ক্যামেরাম্যানের সাথে কথা বলছিলো, সেই সব জায়গা মনে কনফিউশনের জন্ম দিতে পারে। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে যে ডিরেক্টর হিসেবে একটি স্বাধীনতার জায়গা থেকে মনের ভাবটাকে বা উপলব্ধিটাকে তুলে ধরতেই এমনটি করা হয়েছে। নাও হতে পারে, অন্য যে কোনো কারণই হতে পারে। তবে আমার কাছে তা মোটেও ছন্নছাড়া মনে হয় নি।
সিনেমাটির প্রত্যেকটি চরিত্র বাছাইকৃত তা দেখলেই বোঝা যায়। আমরা আমাদের চারপাশে অনেক ধরনের চরিত্র দেখতে পাই। এদের মধ্যে সব চরিত্রই কিন্তু আকর্ষণীয় হয়ে উঠে না। প্রত্যেকটা চরিত্রের আলাদা আলাদা গভীরতা থাকলেও সব চরিত্র কিন্তু মানুষকে টেনে ধরে রাখে না। 'শুনতে কি পাও' দেখে মনে হয়েছে নির্মাতা যেনো দেখেশুনে বুঝে পটভূমির ভূমি থেকে সেই সব চরিত্রই খুঁজে বের করেছেন। কাহিনী বলতে এখানে বিশাল কোনো টুইস্ট নেই, সাদামাটা জীবন যেভাবে যাচ্ছে তাই দেখানো হয়েছে, হয়তো প্রয়োজনে কিছুটা গুছিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে কাহিনী বলার ধরনটা অবশ্যই ভিন্ন ছিলো, যা এই সিনেমাকে অন্যান্য সিনেমা থেকে আলাদা করে রাখে।
এখানে সহস্র বছর ধরে বাঙ্গালীর সংগ্রাম যার সাথে তাই হইতো ছোট্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। যা সম্পর্কে আমার ধারণা বলতে গেলে একদম শূন্যের কোঠায়। শহরে জন্ম নিয়ে বড় হয়ে উঠা আমার মতো একজন মানুষের জন্য এই সিনেমাটি একটি অভিজ্ঞতা স্বরূপ কাজ করবে। সিনেমাটিতে এমনভাবে দর্শককে ধোঁকা দেওয়া হয়েছে যেনো মনে হয় যাদের গল্প দেখানো হচ্ছে তারা তাদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত, তারা যেনো জানেই না যে তাদেরকে ক্যামেরা অনুসরণ করছে। আর আরেকটা বিষয় না বললেই নয় যে, শব্দ পরবর্তীতে সংযোগের ক্ষেত্রে সিনেমার কলাকুশলী ও ডিরেক্টর প্রশংসা পেতেই পারেন।
গ্রামের চায়ের দোকানগুলোকে গ্রামের প্রাণকেন্দ্র বলা যেতে পারে। গ্রামের রাজনীতির হইতো ৬০-৭০ শতাংশ দাবার চাল এখানেই চালা হয়ে থাকে। গ্রামের মানুষগুলোকে চিনতে হলে চায়ের দোকানগুলোয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা আবশ্যক। সিনেমাটিতে একটা জিনিষ বরাবরই স্পষ্ট আর তা হলো গ্রামের মানুষের আত্মনির্ভরশীলতা। সরকার বা গভমেন্ট যেই থাকুক না কেনো তারা এই ব্যপারটি বুঝতে পারে যে নিজেদের বাঁচা মরা নিজেদের হাতেই। তারা সহায়তা কামনা করলেও নিজ জায়গা থেকে তারা কখনো থেমে থাকে না, কেননা সহায়তা কতদূর তাতো সহায়তাকারীও নিশ্চিত নন।
নারীর উন্নয়নের জন্যে আমাদের দেশ এখন আগের থেকে সচেতন হলেও তা যথেষ্ট নয়। নারী আগালে দেশ আগাবে। কথাটি কিন্তু সত্য। যার প্রতিফলন সিনেমার পরিবারেও দেখা যায়। এমনটা যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রবাহিত করা যেতো, তবে হইতো কিছুটা হলেও দেশ আগাতো। বাঁধ নির্মাণে শুধু পুরুষরাই নয়, নারীরাও হাত মিলিয়ে কাজ করে থাকে। প্রয়োজনীয়তাকে অনুভব করার সময় যাচ্ছে, পিছিয়ে পড়ার আগেই নিজেদের তাই এই বিষয়ে ঝালিয়ে নেওয়া দরকার।
জীবনে উঁচু নিচু পথ বাইতেই হবে। খুব সহজ কথায় জীবন যে দিকে নিয়ে যাবে সে দিকে আমাদের যেতেই হবে এবং যখন তাতে বেঁচে থাকার তাগিদা আসবে তখন তা আমাদের পূরণ করতেই হবে। নাহলে টিকে থাকা যাবে না। সেই সংগ্রামই এই পরিবারটি করছে খারাপ ভালোর ভিতর দিয়ে টিকে থাকার জন্য।
আমি এই চলচ্চিত্রের জন্য কামার আহমাদ সাইমনকে অভিনন্দন জানাবো। আমি চাই এই নির্মাতা যেনো অন্তত আরও ৫০টি সিনেমা নির্মাণ করতে পারেন। এই মুহূর্তে আমাদের দেশে এরকম নির্মাতার প্রয়োজন প্রচুর।
Comments